জি নিউজ ডেস্কঃ পুলিশ সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। করোনা মহামারীতে আমাদেশের দেশ আক্রান্ত হওয়ার পর সবচেয়ে তৎপর দেখা গেছে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীকে। আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক কথাবার্তা শুনে আসতেছি। কিন্তু হটাৎ করে পুলিশ বদলে গেল। দেশের মানুষকে করোনার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে তাদের প্রচেষ্টা ছিল আন্তরিক। করোনায় মানুষকে বিধিনিষেধের আওয়তায় নিয়ে আসার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা গেছে পুলিশের মাঝে।
রাস্তায় অহেতুক ঘুরাফিরা করা মানুষকে ঘরে ফেরা, দোকান পাঠ বন্ধে এবং যান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আনার পাশাপাশি মানবিক অনেক কাজে তাদের শামিল হওয়া ছিল প্রশংসার যোগ্য। করোনায় আক্রান্ত অনেক পরিবার সামাজিক ভাবে নিগৃহীত হচ্ছিল, অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে নেয়া অথবা করোনা আক্রান্ত হয়ে অনেক মৃত দেহের সৎকার হচ্ছিলোনা। কবর দেয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ এগিয়ে এসে চরম মানবিকতার পরিচয় দিয়ে সৎকার করেছে।
কিন্তু ছন্দপতন ঘটে যাচ্ছে। ঘোষিত লকডাউন ছিল না, ছিল কিছু বিধিনিষেধ৷ সেনা ছিল, পুলিশ ছিল রাস্তায়, দুই একদিন ধরে আর কিছুই নেই দেশে৷ যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাধারণ মানুষ৷ কারণে-অকারণে রাস্তায় বের হচ্ছেন৷ অলি-গলি দোকানেও ভিড়৷ পুলিশের বা অন্য কারো চেকপোষ্টেরও এখন আর দেখা মিলছে না ৷ ফলে বাঁধা দেওয়ারও কেউ নেই৷ কোথাও কোথাও যানজট ফিরে আসছে চেনা চেহারায়৷ ঢাকার প্রবেশ মুখগুলোও এখন উন্মুক্ত৷
‘লকডাউন’ ভেঙে পড়ায় কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ? জানতে চাইলে রোগ তত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘‘আমি বুঝতে পারছি না, আমরা কি ব্রাজিল বা যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থার দিকে যাচ্ছি? এখন এই শৈথিল্য ভয়াবহ পরিনতির দিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে না তো? আমরা বারবার বলছি, এখন শৈথিল্য দেখানো যাবে না৷ কিন্তু রাস্তা ঘাটে যে অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে করোনা যুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা উৎসব করছি৷ কিছু মানুষ তো প্রয়োজনে বের হচ্ছেন৷ কিন্তু অপ্রয়োজনে বের হওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়৷ এদের নিবৃত্ত করতে হবে৷ এই মাস আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ এটা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরও বুঝতে হবে৷’’
আজ সোমবার রাজধানীতে ঢোকার প্রবেশ মুখগুলোতে দেখা গেছে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও, অবাধে প্রবেশ ও বের হচ্ছেন সাধারণ মানুষ৷ বিভিন্ন পয়েন্টে ছিল যানবাহনের দীর্ঘ সারি৷ বেশিরভাগ চেকপোস্টে ছিল না পুলিশের উপস্থিতি৷ এই সুযোগে প্রাইভেটকার, রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স ও মোটরসাইকেলে অবাধে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে৷ নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডে দেখা যায়নি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা৷ গাবতলী ও আব্দুল্লাহপুরেও ছিল না পুলিশ৷ দেখা গেছে যানবাহনের দীর্ঘসারি৷ ছিল ঢাকামুখী মানুষ ও যানবাহনের চাপ৷
চেকপোষ্টে কেন পুলিশ নেই? সোমবার পর্যন্ত ৯১৪ জন সদস্য আক্রান্ত ও ৫ জনের মৃত্যু হওয়ায় পুলিশ কি শিথিলতা দেখাচ্ছে? জবাবে পুলিশের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা বলেন, ‘‘পুলিশ কোন শিথিলতা দেখাচ্ছে না৷ বাহিনীর সদস্যদের মনোবলও চাঙা আছে৷ বিপুল সংখ্যক সদস্য আক্রান্ত হওয়ায় এখন নানা ধরনের কৌশল নিতে হচ্ছে৷ পৃথক শিফট করা হচ্ছে৷ যাতে একসঙ্গে সবাই আক্রান্ত না হন৷ আইজিপি এ ব্যাপারে নিয়মিত নির্দেশনা দিচ্ছেন৷ আমরা আক্রান্ত সদস্যদের ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখছি৷ তাদের মনোবল চাঙা রাখতে নিয়মিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে৷’’
বিপুল সংখ্যক সদস্য আক্রান্ত হওয়ায় পুলিশের মনোবলে কি চিড় ধরেছে? জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক এক মহাপরিদর্শক বলেন, ‘‘এত সদস্য আক্রান্ত হলে একটু সতর্ক তো হতেই হবে৷ তা না হলে পরে দায়িত্ব পালনের লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ এখন পুলিশকে নানা ধরনের কৌশল নিতে হবে৷ মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বও পালন করতে হবে, আবার সদস্যদেরও নিরাপদে রাখতে হবে৷ এখন উর্ধ্বতনদের দায়িত্বটা বেশি৷ কোন সদস্য যেন মানষিকভাবে ভেঙে না পড়েন সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে৷’’
রাজধানীর খিলগাঁওয়ে পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক কনস্টেবল করোনা আতঙ্কে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন বলে তার পরিবার অভিযোগ করেছে৷ সোমবার সকালে খিলগাঁও তিলপাপাড়ার বাসার পাঁচতলার ছাদ থেকে লাফ দেন তিনি৷ খিলগাঁও থানার ওসি মশিউর রহমান বলেন, ‘‘কনস্টেবল তোফাজ্জল হোসেন কয়েক দিন ধরে অসুস্থ ছিলেন৷ এরপর তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কিনা তার পরীক্ষা করেন৷ কিন্তু পরীক্ষায় রেজাল্ট নেগেটিভ আসে৷ এ নিয়ে তিনি মানসিকভাবে অস্থির ছিলেন বলে তার স্ত্রী আমাদের জানিয়েছেন৷ তোফাজ্জল ভাবছিলেন তিনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, হয়তো টেস্টে ধরা পড়েনি৷ গত কয়েকদিন ধরে এসব চিন্তায় তার ঘুম হচ্ছিল না৷’’
সম্ভবত এ মুহূর্তে পুলিশের হতাশায় ভুগছে। স্বাভাবিক কর্মকান্ডের বাইরে করোনার বিরুদ্ধে এই কর্ম যজ্ঞে আমাদের পুলিশের হয়ত নার্ভাসনেসে ভুগছে। ক্লান্ত বিধ্বস্ত পুলিশ বাহিনী যদি তাদের স্বীয় দায়িত্ব পালনে পিছপা হয় তাহলে দেশকে চরম মাসুল দিতে হবে। করোনার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ে ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধা পুলিশদের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা আছে। তারা যেন পিছুটান না দেয়। পুলিশের প্রতি অবিরাম ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা।
লেখক – লুৎফর রহমান
সাংবাদিক ও কলামিস্ট